প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ধ্বংস-চক্রান্তের প্রতিবাদে আহূত কনভেনশন সফল করুন
ব্লাইন্ড পারসন্স্ অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে শিক্ষা সম্মেলন
সময় | ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, অপরাহ্ণ ৩-৬টা |
স্থান | ফেডারেশন হল্, ২৯৪/২/১ এ.পি.সি. রোড, কোল—৯ |
জানেন কি, প্রতিবন্ধী শিশু অর্থাৎ দৃষ্টিহীন, মূক-বধির এবং মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে? চরম পরিতাপের বিষয়, এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণ উক্ত শিশুদের জন্য অনূসৃত সরকারের ভ্রান্ত শিক্ষা নীতি! এই নীতি গ্রহণের পিছনে কাজ করছে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার আর্থিক দায়ভার অস্বীকার করার মন্দ অভিপ্রায়। এরই জন্য, সর্বশিক্ষা মিশনের নাম করে এই শিশুদের প্রথম শ্রেণী থেকেই নির্বিচারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ বিদ্যালয়ে, যেখানে তাদের অক্ষর পরিচয়টুকুও হচ্ছে না! অর্থাৎ, দৃষ্টিহীনরা ব্রেল আর মূক-বধিররা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতে পারছে না। অন্যদিকে, এই প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যই বিশেষভাবে নির্মিত স্পেশাল স্কুলগুলোকে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার দায়িত্ব স্কুল-শিক্ষা দপ্তরের হাতে না রেখে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জন-শিক্ষা দপ্তরের হাতে থাকার ফলেও প্রয়োজনীয় অর্থানুকূল্যের অভাব ঘটছে। এইভাবে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে সরকার সুকৌশলে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে যে অল্পসংখ্যক প্রতিবন্ধী দেশের বিপুল বেকারবাহিনীতে যোগ দিয়ে বাগাড়ম্বরপ্রিয় সরকারগুলোর ব্যর্থতাকে আরো প্রকট করে তুলছে, সেই লজ্জা ঢাকতেও এই চক্রান্ত খুবই কার্যকরী।
স্বাধীন দেশের কোন সরকারই দৃষ্টিহীনদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের হার বাড়ানোর জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। বরাবরই তারা বিভিন্নরকম ভোকেশনাল ট্রেনিং নেবার জন্যই উৎসাহ দিয়েছে। তাদের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হয়েছি বারবার। তথাকথিত সকলকে শিক্ষিত করার নামে চালু হওয়া “সর্বশিক্ষা মিশন” সরকারের হাতে নতুন সুযোগ এনে দিল। কোন দৃষ্টিহীন, মূক-বধির, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে তার অভিভাবকরা যেন বাড়ির নিকটবর্তী যেকোন বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন, এই মর্মে সরকার জোর প্রচার শুরু করলো। প্রচার যাতে ফলপ্রসূ হয় সেজন্য দরিদ্র অভিভাবকদের হাতে তারা অর্থও তুলে দিতে লাগলেন। এইভাবে একদিকে জনসাধারণকে দেখান গেল যে প্রতিবন্ধীদের উন্নতির ব্যাপারে সরকার খুবই সচেষ্ট। অন্যদিকে যেহেতু এই প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা বলতে কী বোঝায়, সে ধারণা অনেক অভিভাবকেরও নেই তাই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে তারা ভাবলেন, সরকার যা বলছে তেমন করাই ভালো। উপরন্তু হাতে টাকাও পাওয়া যাচ্ছে। আর কে না জানেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রতিবন্ধীই জন্ম নেয় দরিদ্র পরিবারে, কারণ দারিদ্র্যজনিত অপুষ্টি থেকেই আসে পঙ্গুতা।
রবীন্দ্রনাথ রচিত “তোতাকাহিনী” গল্পের কথা স্মরণ করুন। পাখিকে শিক্ষিত করার জন্য সাড়ম্বর আয়োজন হচ্ছে প্রচুর। রাজানুগত কর্মচারীরা টাকাও পাচ্ছে প্রচুর। কিন্তু পাখিটা কিছুই শিখছে না। এখন প্রতিবন্ধী শিশুদের অবস্থাও তদ্রূপ।
আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেহাল অবস্থার কথা স্মরণ করুন। এরাজ্যের অধিকাংশ বিদ্যালয় একজন বা দু’জন শিক্ষক দিয়ে চলে। অনেক স্কুলের ঠিকমত শ্রেণীকক্ষই নেই। এই পরিবেশে সাধারণ ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানই ঠিকমত হয় না, আর প্রতিবন্ধী শিশুদের কথা তো বলাই বাহুল্য। এই শিক্ষকরা ব্রেল বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ানোর কায়দাই চানেন না। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা না থাকার ফলে এই হতভাগ্য শিশুরা যে প্রকৃতপক্ষে কিছুই শিখছে না, তা সময়মত ধরাও পড়ে না। শুধুমাত্র কিছু নামতা আর ছড়া মুখস্থ করেই এরা পেরিয়ে যাচ্ছে অষ্টম শ্রেণীর গণ্ডী। তারপরই দুর্ভাগাদের শিক্ষাজীবনের যবনিকাপাৎ।
এই ব্যবস্থার ফাঁকিটা যাতে সহজে ধরা না পড়ে, সেজন্য স্পেশাল এডুকেটর নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এদের কাজ, একটা সার্কেলে অবস্থিত সমস্ত স্কুলে ঘুরে ঘুরে দৃষ্টিহীনদের ব্রেল, মূক-বধিরদের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আর মানসিক প্রতিবন্ধীদের বিশেষ জেস্চার-পস্চারের মাধ্যমে ট্রেনিং দেওয়া। মজা হল, ছুটি পরব ধরে নিয়ে হিসাব করলে দেখা যায়, এক-একটা বিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ঘুরে যেতে এদের সময় লেগে যায় আড়াই থেকে তিন মাস। পড়ানোর পাশাপাশি প্রকল্পের খাতাপত্র তৈরির কাজও তাদের করতে হয়। ১৬.০৭.২০১৬ তারিখে বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার জনৈক স্পেশাল এডুকেটর ইন্দ্রজিৎ মিত্রকে ৭৪টি স্কুলে ঘুরে ঘুরে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। কোন শিশু যতই মেধাবী হোক, এত কম ট্রেনিংয়ে কারোর পক্ষেই কিছু আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। এই স্পেশাল এডুকেটররাও অকপটে স্বীকার করেন তাদের অক্ষমতা। তাদের নিয়োগ হয় চুক্তির মাধ্যমে। মাইনে অল্প, খাটুনি প্রচুর। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের বক্তব্য এই ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে।
অনেক অভিভাবক বিলম্বে হলেও ভুল বুঝতে পেরে তাদের সন্তানকে নিয়ে আসেন স্পেশাল স্কুলে। এখানেই হয় তাদের হাতেখড়ি। আর কিছু না হোক, একটা স্পেশাল ব্লাইন্ড স্কুলে একজন দৃষ্টিহীন ব্রেলের মাধ্যমে অন্তত অক্ষরপরিচয়ের সুযোগটুকু পায়। শিখতে পারে খেলাধূলা, গানবাজনা। ডেইলি লিভিং আর মোবিলিটি-র মাধ্যমে নিজের কাজ নিজে করতে পারে, চলাফেরায় চৌখস হয়ে ওঠে। মঁসিয়ে লুই ব্রেল যদি স্পেশাল স্কুলে না ভর্তি হতেন, ব্রেল আবিষ্কারের সূত্র হয়তো তাঁর অধরাই থেকে যেত। মহীয়সী নারী পেলেন কেলারের বাড়িতে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে পাঠান হয়েছিল স্পেশাল স্কুলে, সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধনের জন্য।
এই স্পেশাল স্কুলগুলোর উপস্থিতির জন্যই প্রতিবন্ধী-শিক্ষা সংহার-নীতি পুরোপুরি সফলকাম হচ্ছে না। তাই এই স্কুলগুলোকে সবদিক থেকে দুর্বল করে বন্ধ করে দেবার অপচেষ্টা চলছে। কোচবিহার গভর্নমেন্ট ব্লাইন্ড স্কুলকে সরকার সুকৌশলে হোমে পরিণত করেছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণমিশন ব্লাইন্ড বয়েজ একাডেমির মত বিখ্যাত স্কুলে –টি, বেহালায় অবস্থিত এদেশের প্রাচীনতম ক্যালকাটা ব্লাইন্ড স্কুলে –টি এবং অন্যান্য স্কুলেও বহু শিক্ষকের পদ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই বছরের পর বছর পূরণ করেনি। জন-শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন যে ১০-১২ বছরের পুরনো শূন্য পদগুলিতে স্থায়ী শিক্ষকের পরিবর্তে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে। কয়েকটি ব্লাইন্ড স্কুল যেমন পূর্ব মেদিনীপুরের চৈতন্যপুরে অবস্থিত বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম আবাসিক দৃষ্টিহীন বিদ্যালয়, পুরুলিয়ার মানভূম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষায়তন, হুগলির উত্তরপাড়ায় অবস্থিত লুই ব্রেল মেমোরিয়াল স্কুল ফর্ দ্য সাইটলেস-এ কোন দৃষ্টিহীন শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না। ফলে ব্রেলের মাধ্যমে শিক্ষাদান অবহেলিত হচ্ছে। নিয়োগ করার সময়ও হাস্যকরভাবে সাইন্সের পোস্টে হয়ত নেওয়া হচ্ছে ইতিহাসের লোক। অসহায় প্রতিবন্ধীদের দুর্দশা আর দেখে কে?
এই ভ্রান্ত শিক্ষা নীতি আর শিক্ষার দায়ভার ঝেড়ে ফেলার সরকারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আজ সময় এসেছে জোরাল প্রতিবাদের। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকব। লুই ব্রেল, হেলেন কেলার, আচার্য লালবিহারী শাহ্-র মত মানুষদের সংগ্রাম ব্যর্থ হবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে সংগঠন আগামী ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ ফেডারেশন হলে নিম্নলিখিত দাবীসমূহের ভিত্তিতে একটি কনভেনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঐ দিন বৃহত্তর আন্দোলন পরিচালনার উত্তেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হবে। এই কনভেনশন সফল করতে এবং পরবর্তী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা আপামোর জনসাধারণের বুদ্ধি-পরামর্শ আর আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবার আবেদন জানাচ্ছি।
আমাদের দাবী
- ১) “সর্বশিক্ষা মিশন” বা “সমণ্বিত শিক্ষা” নয়, উচ্চ-প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত দৃষ্টিহীন, মূক-বধির, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা স্পেশাল স্কুলের মাধ্যমেই দিতে হবে;
- ২) স্পেশাল স্কুলগুলিতে সমস্ত শূন্য পদে অবিলম্বে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে;
- ৩) প্রতিটি স্পেশাল স্কুলে এমন প্রতিবন্ধী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে যারা নিজেরা ব্রেল বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করেন;
- ৪) স্পেশাল এডুকেটরদের স্থায়ী পূর্ণ সময়ের শিক্ষকরূপে নিয়োগ করতে হবে; এবং
- ৫) প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা জন-শিক্ষা দপ্তরের পরিবর্তে স্কুল-শিক্ষা দপ্তরের অধীনে আনতে হবে।